এই অধ্যায়ে আমরা ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসন সংস্কার ১৭৭২-৮৪ খ্রিঃ [ The Reforms of Warren Hastings ] নিয়ে আলোচনা করব।
হেস্টিংসের সমস্যা :
বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের এক বিরাট অংশে কোম্পানীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এইসব স্থানে দীর্ঘদিন কোন সুশাসন প্রবর্তিত হয়নি। কোম্পানীর দেওয়ানী লাভের পর বাংলায় যে দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ফলে বাংলার জনজীবনে ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে সারা বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। এই অবস্থায় ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর এবং পরে (অক্টোবর, ১৭৭৪ খ্রিঃ) গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। তাঁর প্রতি কোম্পানীর পরিচালক সভার নির্দেশ ছিল যে, কোম্পানী যেন সরাসরি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। এইভাবে তাঁর হাতে এক নতুন ধরনের সরকার গঠনের ভিত্তি রচিত হয় (“… the foundations of a new system of government were laid. -History of the Freedom Movement in India, Vol. I, Tara Chand, P. 242.)।
সুশাসক :
ক্লাইভ বাংলাদেশে কোম্পানীর রাজত্বের যে সূচনা করেছিলেন, দক্ষ প্রশাসক ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে দৃঢ় ভিত্তি দেন। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পীয়ার ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের তুলনা করে বলেন যে, “বিজেতা হিসেবে বড় হলেও, বিজিত দেশে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রবর্তনের যোগ্যতা ক্লাইভের ছিল না। এ কাজে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী অনেক বেশি দৃঢ়তা ও বিজ্ঞতার পরিচয় দেন।” তাঁর মতে, ওয়ারেন হেস্টিংস প্রশাসনিক স্থাপত্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরাপর প্রশাসকরা তার ওপর একটি বিশাল সৌধ নির্মাণে সক্ষম হন। (“He laid the foundation of the administrative structure upon which others were to rear a stately edifice.”)। ঐতিহাসিক আলফ্রেড লায়াল বলেন, যে, ”শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে হেস্টিংস তাঁর মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।”
প্রশাসনিক সংস্কার :
দ্বৈত শাসন লোপ : বাংলার শাসনভার হাতে পেয়ে প্রথমেই তিনি দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান (এপ্রিল, ১৭৭২ খ্রিঃ) এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানী গ্রহণ করে। নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ ও সিতাব রায় পদচ্যুত হন এবং এই পদ দু’টি বিলোপ করা হয়। বাংলার নবাবের বাৎসরিক ভাতা ৩২ লক্ষ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ লক্ষ টাকা করা হয়। সরকারি কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
রাজস্ব সংস্কার :
পাঁচসালা বন্দোবস্ত :
ওয়ারেন হেস্টিংস এর রাজস্ব ব্যবস্থা : রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের চার জন সদস্যকে নিয়ে একটি ‘ভ্রাম্যমাণ কমিটি’ (Committee of Circuit) গঠিত হয় (১৪ই মে, ১৭৭২ খ্রিঃ)। এই কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে ইজারাদারদের নীলামে জমি বন্দোবস্তু দেয়। যে-ইজারাদার কোম্পানীকে সর্বোচ্চ কর দিতে রাজি হয়, তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা ‘ইজারাদারী ব্যবস্থা’ বা ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’ (১৭৭২- ৭৭ খ্রিঃ) নামে পরিচিত। ইতিপূর্বে ‘সুপারভাইজার’ নামক কর্মচারীরা কোম্পানীর রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় তদারক করত। হেস্টিংস এদের নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’। এইসব ইংরেজ কর্মচারী জেলায় রাজস্ব আদায় এবং বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পায়।
ত্রুটি ও একসালা বন্দোবস্তু :
পাঁচসালা বন্দোবস্তে নানা অসুবিধা দেখা দেয়। (১) অসাধু ইজারাদাররা বহুক্ষেত্রে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালাত। (২) নীলামের মাধ্যমে জমি ইজারা দেওয়ার ফলে চিরাচরিত জমিদাররা অনেকেই জমিদারীচ্যুত হন এবং তাঁদের স্থান দখল করে ভূঁইফোড় ইজারাদার। (৩) নবনিযুক্ত ইজারাদাররা বহুক্ষেত্রেই কোম্পানীকে ঠিকমতো রাজস্ব দিত না। এর ফলে কোম্পানীর আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। (৪) জমিতে ইজারাদারদের স্বত্ব অনিশ্চিত হওয়ায় তারা জমি ও কৃষকের উন্নতির দিকে নজর দিত না। এইসব অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যে হেস্টিংস ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এই ব্যবস্থায় প্রতি বছর নীলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। এই ব্যবস্থাও প্রজার পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি।
(১) ইতিমধ্যে “ভ্রাম্যমাণ কমিটি’ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে হেস্টিংস এই কমিটি বাতিল করে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে একটি ‘রাজস্ব বোর্ড’ গঠন করেন। গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের সব সদস্যই এই বোর্ডের সদস্য রাজস্ব বোর্ড, প্রাদেশিক কাউন্সিল ও আমিনী কমিশন ছিলেন। দেওয়ানী-সংক্রান্ত সকল কাজের দায়িত্ব এই বোর্ডের ওপর অর্পিত হয়। (২) ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে ছয়টি অংশে ভাগ করে প্রত্যেক অংশে একটি করে প্রাদেশিক কাউন্সিল’ (Provincial Council) গঠন করেন। প্রত্যেক কাউন্সিলে একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিয়োগ করা হয়। এ সময় কালেক্টর পদ তুলে দেওয়া হয়। (৩) ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ‘আমিনী কমিশন’ গঠন করেন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলি বিলোপ করে পুনরায় কালেক্টর পদ চালু করে তাদের হাতে জেলা প্রশাসনের সকল দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার দ্বারা প্রজাবর্গের কোন মঙ্গল হয়নি, বরং এতে জটিলতাই বৃদ্ধি পায়। একদিকে জমিদারের ওপর রাজস্ব আদায়কারী এবং অন্যদিকে কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। এই ব্যবস্থার ফলে বাংলার প্রাচীন ও বৃহৎ জমিদারীগুলি বিপন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়াও জমির মালিকানা অনিশ্চিত হওয়ায় জমির উন্নয়ন ব্যাহত হয়। ড. তারা চাঁদ বলেন যে, হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার ভারতের প্রাচীন গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর চরম আঘাত হানে (“Warren Hastings had dealt a terrific blow to the ancient edifice of Indian rural economy. History of the Freedom Movement in India, Vol. I, Tara Chand, P. 245.)।
বাণিজ্য সংস্কার :
ওয়ারেন হেস্টিংস এর অবদান এর নানাবিধ অবদানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল বাণিজ্য সংস্কার । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নতির জন্য ‘রাজস্ব বোর্ড’-এর নির্দেশে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস ‘দত্তক’ বা কোম্পানীর কর্মচারীদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যের প্রথা রদ করেন। দেশী-বিদেশী সব বণিককেই কেনা-বেচার ওপর ২১% % হারে শুল্ক দিতে বাধ্য করা হয়। জমিদারদের নিজস্ব ‘চৌকী’ বা শুল্ক আদায়ের ঘাঁটিগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে সমগ্র প্রদেশে মাল চলাচল সহজতর হয়ে ওঠে। কেবল মুর্শিদাবাদ, নালী, কলকাতা, পাটনা ও ঢাকা—এই পাঁচটি জায়গায় গুপ্ত- চৌকী রাখা হয়। লবণ, তামাক ও সুপারির পাইকারি বাণিজ্যের ওপর কোম্পানীকে একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়। বাণিজ্য বিভাবের উদ্দেশ্যে তিনি ভুটান ও তিকাতে বাণিজ্য-প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তিনি মুদ্রার ওজন ও মান স্থির করে দেন।
বিচারবিভাগীয় সংস্কার :
ওয়ারেন হেস্টিংস বিচার ব্যবস্থা বা ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার বিভাগীয় সংস্কার : দ্বৈত শাসনের কালে বিচারব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে এবং তাতে নানা দুর্নীতি ও গলদ প্রবেশ করে। হেস্টিংস বিচারব্যবস্থায় নানা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। তিনি বাংলাকে ৩৫টি জেলায় করেন। প্রত্যেক জেলায় তিনি একটি করে মফস্বল দেওয়ানী আদালত ও মফস্বল ফৌজদারী আদালত স্থাপন করেন। জেলা কালেক্টর হিন্দু পণ্ডিত ও কাজীর সাহায্য নিয়ে উভয় আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। পণ্ডিত ও কাজীর সাহায্যে হিন্দু-মুসলিম আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালিত হত। মফস্বল দেওয়ানী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতায় অবস্থিত সদর দেওয়ানী আদালতে আপিল করা যেত। গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের দু’জন সদস্য এই আদালতের বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। মফস্বল ফৌজদারী আদালতের ওপরে ছিল মুর্শিদাবাদে অবস্থিত সদর নিজামত আদালত। নবাব ছিলেন এর বিচারক। নবাবের প্রতিনিধি ও প্রধান কাজী এর বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিল এই আদালতের কাজের ওপর নজর রাখতেন। মফস্বল ফৌজদারী আদালত কারো প্রাণদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে সদর নিজামত আদালতের সম্মতি লাগত।
বিচারব্যবস্থার উন্নতিকল্পে তিনি আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি এদেশে আইনের শাসন (Rule of Law) এবং আইনের চোখে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। আদালতে মোকদ্দমার নথিপত্র সংরক্ষণ, ঘটনার বার বছর পর মোকদ্দমার অধিকার বাতিল, দেওয়ানী বিচারে হিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দুশাস্ত্র ও মুসলিমদের ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের প্রয়োগ, কাজী-মুফতি প্রমুখ বিচারকদের নিয়মিত বেতন দান প্রভৃতির ব্যবস্থাও তাঁর আমলে প্রবর্তিত হয়। সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচারসংস্কার / ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাই।
পুলিশী সংস্কার :
ওয়ারেন হেস্টিংসের সংস্কার এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পুলিশী সংস্কার বা পুলিশ ব্যবস্থা । মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কালে দেশে পুলিশী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে পুলিশী ব্যবস্থা একরকম অবলুপ্ত হয়ে যায়। v. এমতাবস্থায় ওয়ারেন হেস্টিংস-ই প্রথম এদেশে পুলিশী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি মোটামুটিভাবে মোগল যুগের পুলিশী ব্যবস্থার সঙ্গে কয়েকটি সংযোজন করেন। দেওয়ান বা নাজিম রাজ্যে শাস্তি- শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। (১) বাংলা ও বিহারকে যথাক্রমে দশ ও আটটি ফৌজদারী জেলায় বিভক্ত করা হয়। (২) প্রত্যেক জেলায় একটি করে ফৌজদারী থানা স্থাপিত হয় এবং এই থানাগুলিতে একজন করে দেশীয় ফৌজদার নিযুক্ত হন। (৩) ফৌজদার ছিলেন জেলার প্রধান পুলিশ কর্মচারী এবং জেলায় শান্তিরক্ষার সকল দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত ছিল। (৪) প্রত্যেক থানার সঙ্গে একটি করে জেলখানা স্থাপন করা হয়। (৫) ফৌজদারকে সাহায্য করার জন্য ৩৪ জন কর্মচারী ছিল এবং তাদের মধ্যে ২০ জন ছিল সিপাই। বলা বাহুল্য, এত কম সংখ্যক লোক নিয়ে সমগ্র জেলায় শান্তি রক্ষা করা ফৌজদারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। (৬) ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ফৌজদারের পদ তুলে দেওয়া হয় এবং কোম্পানীর দেওয়ানী আদালতের বিচারকরা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পেয়ে পুলিশ বিভাগেরও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিছু কেরানী ও বরকন্দাজ তাদেরকে পুলিশী কাজে সাহায্য করত। বলা বাহুল্য, এর ফল ভাল হয়নি। (৭) শহরের শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ছিল কোতোয়ালদের হাতে। (৮) জমিদাররা নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন।
কোম্পানীর শাসনের এক দুর্যোগময় মুহূর্তে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। কোম্পানীকে তিনি একটি নিছক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে করেন। হান্টার (Hunter) বলেন যে, হেস্টিংস বাংলায় অসামরিক শাসনব্যবস্থার একটি দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেন (“Hastings firmly laid the foundation of civil administration.”)। ড. স্পীয়ারের মতে তিনি ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যথার্থ প্রতিষ্ঠাতা (“Hastings can be called the real founder of the British dominion in India. ” – A History of India. Part II, P. 92 ) ।