এই অধ্যায়ে আমরা ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক [ The Anglo-Sikh Relations ] নিয়ে আলোচনা করব।
গুরু গোবিন্দ সিংহ ‘খালসা’ বাহিনী সংগঠিত করে শিখদের একটি সামরিক জাতিতে পরিণত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বান্দা-র নেতৃত্বে (১৭০৮-১৬ খ্রিঃ) শিখদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বার হয়ে ওঠে। মোগলদের দুর্বলতার সুযোগে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাওয়ালপিণ্ডি ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে শিখরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শিখদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হলেও সমগ্র পাঞ্জাবে তারা কোন ঐক্যবদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। তারা বারোটি ‘মিল’ বা দলে বিভক্ত হয়ে পাঞ্জাব শাসন করত, তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না এবং পরস্পরের মধ্যে সর্বদাই বিবাদ চলত। এমতাবস্থায় সুকারচুকিয়া মিলের নায়ক রণজিৎ সিংহ অন্যান্য মিলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে পাঞ্জাবের এক বৃহত্তর অংশে শিখ রাজ্য গড়ে তোলেন।
রণজিৎ সিংহ (১৭৮০-১৮৩৯ খ্রিঃ) :
পাঞ্জাবের সুকারচুকিয়া মিসলের অধিপতি মহাসিংহের পুত্র রণজিৎ সিংহ ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র বারো বছর বয়সে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর তিনি সুকারচুকিয়া মিলের অধিপতি হন। আফগানিস্তানের অধিপতি জামান শাহ-র ভারত আক্রমণকালে রণজিৎ সিংহ তাঁকে সাহায্য করেন এবং এর বিনিময়ে জার্মান শাহ তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে লাহোরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন (১৭৯৯ খ্রিঃ)। এর কিছুকাল পরেই তিনি জামান শাহের অধীনতা অস্বীকার করে লাহোরে নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্ে তিনি অমৃতসর এবং ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভাঙ্গি, রামগড়িয়া কানহাইয়া, আলুওয়ালিয়া প্রভৃতি শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীরে সবগুলি মিল একে একে দখল করেন।
শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরস্থ রাজ্যসমূহ :
অতঃপর তিনি শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরস্থ রাজ্যগুলি জয় করে এক ‘অখিল শিখ রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি এই অঞ্চলে তিনবার অভিযান চালান ও লুধিয়ানা দখল করেন (১৮০৬ খ্রিঃ)। শতদ্রুর পূর্ব তীরের রাজ্যগুলি রণজিৎ সিংহের বশ্যতা স্বীকারে রাজি ছিল না। এই অঞ্চলের শিখ নায়কেরা ইংরেজের শরণাপন্ন হন। সামরিক ও রাজনৈতিক কারণে শতদ্রুর তীরস্থ অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রণজিৎ সিংহের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গভর্নর জেনারেল মিন্টো শঙ্কিত হন, কিন্তু এই সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফরাসী আক্রমণের আশঙ্কা থাকায় তিনি রণজিৎ সিংহকে ক্ষুব্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
অমৃতসরের সন্ধি :
বড়লাট মিন্টোর নির্দেশে চার্লস মেটকাফ লাহোরের দরবারে হাজির হয়ে রণজিৎ সিংহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন এবং ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে দুই পক্ষে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে শতদ্রু নদীর পশ্চিম-তীরস্থ রাজ্যগুলির ওপর রণজিৎ সিংহের কর্তৃত্ব স্বীকৃত হয় এবং শতদ্রুর পূর্ব-তীরবর্তী অঞ্চলগুলির ওপর থেকে তিনি তাঁর দাবি ত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক কানিংহাম (J. D. Cunningham) বলেন যে, এই চুক্তি রণজিৎ সিংহের-এর পক্ষে লাভজনক ছিল, কারণ এর দ্বারা শতদ্রু নদী কোম্পানীর সঙ্গে তাঁর রাজ্যের প্রাকৃতিক সীমানা বলে চিহ্নিত হয় এবং তিনি শতদ্রুর পশ্চিম তীরে ইচ্ছামতো রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পান। ড. এন. কে. সিংহ (Dr. N. K. Sinha)-র মতে এই চুক্তি তাঁর কুটনৈতিক ও সামরিক পরাজয়ের নিদর্শন। তিনি এই চুক্তিকে ‘শিখ সামরিক-জাতীয়তাবাদের বিয়োগান্তক ঘটনা’ (“His failure to absorb the Cis-Sutlej states was a tragedy of Sikh militant nationalism.”) বলে অভিহিত করেছেন। বলা বাহুল্য, এর ফলে রণজিৎ সিংহের অখিল শিখরাজ্য’ স্থাপনের স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং তিনি ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন। ড. সিংহ আরও বলেন যে, বিসমার্ক যখন কোন রাজনৈতিক মৈত্রী স্থাপন করতেন তখন তিনি নিজেকে অশ্বারোহী সওয়ার ও সন্ধির অপরপক্ষকে অশ্বে পরিণত করতেন, কিন্তু এই সন্ধিতে রণজিৎ সিংহ অশ্ব এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষ আরোহীর ভূমিকা পালন করে (“In the Anglo-Sikh alliance during Ranjit Singh, the British Government became the rider and Ranjit Singh was the horse.”)। বলা হয় যে, ইংরেজ শক্তির ভয়ে যুদ্ধ এড়াবার জন্য তিনি ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন। কিন্তু দুই পক্ষের যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। রণজিৎ সিংহ এই সমস্যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে রাজ্যবিস্তার :
শতদ্রু নদীর পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রণজিৎ সিংহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন। তিনি একে একে কাংড়া, পাঠানকোট, শিয়ালকোট, পশ্চিম দিকে রাজ্য মুলতান (১৮১৮ খ্রিঃ) জয় করেন। আফগানদের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সংঘর্ষ হয় বিস্তার এবং তিনি আটক (১৮১৩ খ্রিঃ), নৌশেরা (১৮২৩ খ্রিঃ), ডেরা গাজী খাঁ, ডেরা ইসমাইল খাঁ, কোহট, বান্নু, পেশোয়ার (১৮৩৪ খ্রি:) প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন। কাশ্মীর (১৮১৯ খ্রিঃ) ও লাডাক (১৮৩৪ খ্রিঃ) তাঁর দখলে আসে।
১৮৩১ খ্রিঃ-এর সন্ধি :
রণজিৎ সিংহের রাজ্যে কোন সমুদ্র উপকূল ছিল না। তাই তিনি সিন্ধুদেশ জয়ে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু সিন্ধুদেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ইংরেজ, কর্তৃপক্ষ তাঁর সিন্ধুদেশ জয়ে বাধা দেয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক সিন্ধুদেশে রণজিৎ সিংহের অগ্রগতি রোধ করার জন্য কূটনৈতিক দূতরূপে আলেকজান্ডার বার্নেসকে শিখ-দরবারে প্রেরণ করেন। ঠিক এই সময় আবার পারস্যে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পেলে ইংরেজরা ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক লাহোরে উপস্থিত হয়ে রণজিৎ সিংহের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ‘চিরস্থায়ী মিত্রতা’ স্থাপন করেন। এইভাবে সিন্ধু অঞ্চলে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা থেকে তাকে নিরস্ত করে।
ত্রিশক্তি মৈত্রী :
আফগানিস্তানের গৃহবিবাদে শাহ সুজা সিংহাসন চ্যুত হন এবং দোস্ত আলি সিংহাসনে বসেন। দোস্ত আলির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। এই অবস্থায় শাহ সুজাকে আফগানিস্তানের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ, শাহ সুজা ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে এক ত্রিশক্তি মিত্রতা চুক্তি (১৮৩৮ খ্রিঃ) স্বাক্ষরিত হয়। এরই ফলে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু ঘটে।
কৃতিত্ব :
রণজিৎ সিংহ ভারত ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন (“Ranjit Singh is one of the most important personalities in the history of modern India. “K, K. Datta, vide Advanced History of India, P. 739 )। শিবাজী ও হায়দার আলির মতো নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও বাহুবল, আত্মবিশ্বাস ও বিচক্ষণতার সাহায্যে বিবদমান শিখরাজ্যগুলির এক বিরাট অংশকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হন। সততা, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, রণজিৎ সিংহ শাসিত পাঞ্জাবকে কখনই একটি শিখরাজ্য বলা সঙ্গত হবে না (“In fact, in no sense was the Punjab, ruled by Ranjit Singh, a Sikh state.”-Modern India, Bipan Chandra, P. 28)।” এই রাজ্যের শাসনব্যবস্থা কেবল শিখ-স্বার্থেই প্রযুক্ত হত না। তাঁর সেনাবাহিনী কেবল শিখদের নিয়ে গঠিত ছিল না–গুর্খা, বিহারী, পাঠান, ওড়িয়া, ডোগরা, পাঞ্জাবী মুসলমান সকলকে নিয়েই এই সেনাবাহিনী গঠিত ছিল। কামান নির্মাণের জন্য তিনি লাহোরে একটি আধুনিক ঢালাই কারখানা স্থাপন করেন। এটি মুসলিম গোলন্দাজদের দ্বারা পরিচালিত হত। তাঁর বিশিষ্ট মন্ত্রী ও সেনানায়কদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু বা মুসলিম। তাঁর সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ও বিশিষ্ট অমাতা ছিলেন ফকির আজিজউদ্দিন এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী ছিলেন দেওয়ান দীননাথ। সেনাদলকে আধুনিক প্রথায় শিক্ষিত করে তুলবার উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু ফরাসী, ইটালীয়, ইংরেজ, জার্মান, রুশ প্রভৃতি সেনানায়কদের নিযুক্ত করেন। এক সময় তাঁর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের কাজে ৩৯ জন ইওরোপীয় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অ্যালার্ড, ভেঞ্চুরা, অ্যাভিটেবিল, কোর্ট প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জনৈক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, সুদক্ষ সেনানায়কদের প্রশিক্ষণের ফলে তাঁর সেনাবাহিনী বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীতে পরিণত হয় (“The rank and file of the Sikh army became under the training of the skilled officers, the finest rank and file in the world.”) ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, তৎকালে এশিয়া মহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাবাহিনী ছিল প্রথম স্থানের অধিকারী এবং তাঁর সেনাবাহিনীর স্থান ছিল দ্বিতীয়।
সমালোচনা :
ফরাসী পর্যটক ভিক্টর জ্যাকিমো তাঁকে ‘নেপোলিয়নের ক্ষুদ্র সংস্করণ’ (‘a Bonaparte in miniature’) বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক স্পীয়ারের মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দু’জন অসাধারণ পুরুষের একজন হলেন রামমোহন রায় এবং অপর জন হলেন রণজিৎ সিংহ (“Ranjit with Ram Mohan Roy were the most remarkable Indians of their generations “)। বহু গুণাবলী ও কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রণজিৎ সিংহের বেশ কিছু ত্রুটিও ছিল। (১) তিনি কোন যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরি করে যাননি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর শিখরাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। (২) তিনি ‘খালসা’ সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করেননি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর ‘খালসা’ বাহিনী প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে রাজাকে দুর্বল করে দেয়। (৩) তিনি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন, কিন্তু পাঞ্জাবের রাজস্ব থেকে তার ব্যয়-নির্বাহ করা সম্ভব ছিল না। (৪) অনেকের মতে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর করে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে যান এবং ইংরেজদের মোকাবিলার দায়িত্ব তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের ওপর অর্পণ করেন। বলা বাহুল্য, বাস্তববোধই তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেনি। এছাড়া, টিপু সুলতান ও মারাঠা নায়কদের পরিণতি তার স্মরণে ছিল।
ইংরেজদের পাঞ্জাব জয় (১৮৪৯ খ্রিঃ) :
শিখরাজ্যে গোলযোগ :
রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অহিফেন- সেবী ও অপদার্থ খড়গ সিংহ সিংহাসনে বসেন। তাকে প্রায় বন্দীদশায় রেখে তাঁর পুত্র নওনেহাল সিংহ শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৮৪০-এ খড়গ সিংহের মৃত্যু ঘটে এবং তার পরের দিনই এক দুর্ঘটনায় নওনেহাল সিংহের মৃত্যু হয়। ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে রণজিৎ সিংহের অন্য পুত্রদের মধ্যে তীব্র বিবাদ বাধে। শেষ পর্যন্ত ‘খালসা’ বাহিনীর দুই নায়ক লাল সিংহ ও তেজ সিংহ রণজিৎ সিংহের নাবালক পুত্র দলীপ সিংহ-কে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্যের সকল ক্ষমতা হস্তগত করেন। রাজমাতা ঝিন্দন দলীপ সিংহের অভিভাবিকা নিযুক্ত হন।
প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (১৮৪৫-৪৬ খ্রিঃ) :
কারণ : ‘খালসা’ বাহিনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। বীর ও সাহসী হলেও তাঁরা ছিলেন স্বার্থপর ও ক্ষমতালোভী। দরবারে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয় এবং শিখ নেতৃবৃন্দ খালসা বাহিনীর ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে যে, খালসা বাহিনীর ঔদ্ধত্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই রাজমাতা ঝিন্দন তাদের ইংরেজ রাজ্য আক্রমণে প্ররোচনা দেন। বলা বাহুল্য, এ মত সঠিক নয়, বরং শিখ রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজ পক্ষই পাঞ্জাব দখলের জন্য তৈরি হচ্ছিল। লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-৪৮ খ্রি:) শতদ্রু নদীর পূর্ব-তীরস্থ দুর্গগুলিতে ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যাবৃদ্ধি করেন, সেখানে তাদের নিয়মিত কুচকাওয়াজ শুরু হয়, শতদ্রুর ওপর সেতু নির্মাণ শুরু হয় এবং মুলতান সীমান্তে একদল ইংরেজ সৈন্যের আগমন ঘটে। ইংরেজদের এইসব কার্যকলাপে শিখরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এছাড়া, লাহোর দরবারে অবস্থিত ইংরেজ রেসিডেন্ট মেজর ব্রডফুটের উদ্ধত আচরণ ও অপমানজনক ব্যবহার শিখদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমতাবস্থায় রাজমাতা ঝিন্দন খালসা বাহিনীকে ইংরেজদের আক্রমণে প্রণোদিত করেন। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর শিখবাহিনী শতদ্রু অতিক্রম করে ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করলে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয়। মুদকী (১৮৪৫ খ্রিঃ), ফিরোজ শাহ (১৮৪৫ খ্রিঃ), আলিওয়াল (১৮৪৬ খ্রিঃ) ও সেরাও (১৮৪৬ খ্রিঃ)-এর যুদ্ধে যথার্থ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তেজ সিংহ ও লাল সিংহের ‘নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতায়’ চারটি যুদ্ধেই শিখবাহিনী পরাজিত হয়।
লাহোর সন্ধি :
বিজয়ী সেনাদল লাহোর দখল করলে শিখরা অপমানজনক লাহোরের সন্ধি (মার্চ, ১৮৪৬ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে (১) বিপাশা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী জলন্ধর দোয়াব এবং শতদ্রু নদীর দক্ষিণস্থ সকল ভূভাগ ইংরেজদের হাতে সমর্পিত হয়। (২) ক্ষতিপূরণ হিসেবে শিখদের দেড় কোটি টাকা দিতে হয়—কিন্তু তাদের এত টাকা দেবার সামর্থ্য না থাকায় তারা কাশ্মীর রাজ্যটি ইংরেজদের ছেড়ে দেয়। (৩) শিখ সৈন্যের সংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং (৪) লাহোরে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি (রেসিডেন্ট) রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে শিখরাজ্যে কার্যত ব্রিটিশ শাসনই প্রবর্তিত হয় এবং ইংরেজ রেসিডেন্ট স্যার হেনরী লরেন্স-ই রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার নিয়ামকে পরিণত হন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (১৮৪৮-৪৯ খ্রিঃ) :
স্বাধীনতা-প্রিয় শিখদের পক্ষে লাহোরের অপমানজনক সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। লাহোরে ইংরেজ সেনাদলের অবস্থিতি, তৎকালীন ইংরেজ রেসিডেন্ট জন লরেন্সের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও শিখ নেতৃবৃন্দের প্রতি অপমানজনক ব্যবহার শিখদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। রাজমাতা ঝিন্দন-কে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে চুনার দুর্গে নির্বাসিত করা হলে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ অচিরেই বিদ্রোহে পরিণত হয়। মুলতানের শাসনকর্তা মুলরাজ এবং হাজারার শাসনকর্তা ছত্তর সিংহ বিদ্রোহে যোগ দেন। সমগ্র পাঞ্জাবে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। পেশোয়ার ফিরে পাওয়ার আশায় আফগানিস্তানের আমীর দোস্ত মহম্মদ শিখদের পক্ষে যোগদান করেন। চিলিনওয়ালার যুদ্ধে (জানুয়ারি, ১৮৪৯ খ্রিঃ) শিখরা জয়যুক্ত হলেও গুজরাটের যুদ্ধে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৯ খ্রিঃ) তারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয় এবং ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ডালহৌসী এক ঘোষণাপত্র মারফৎ পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
ফলাফল :
এই যুদ্ধের ফলে (১) সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং রণজিৎ সিংহের প্রতিষ্ঠিত শিখরাজ্যের পতন ঘটে। (২) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। (৩) বিদ্রোহের অভিযোগে দলীপ সিংহ সিংহাসনচ্যুত হন এবং ইংরেজদের বৃত্তিভোগী হয়ে লন্ডনে নির্বাসিত হন। (৪) খালসা বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়।
সমালোচনা :
বিদ্রোহের অজুহাতে দলীপ সিংহের পদচ্যুতি ও ইংরেজদের পাঞ্জাব অধিকার নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে কোনক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। মূলরাজের বিদ্রোহ ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দলীপ সিংহ কোনক্রমেই দায়ী ছিলেন না, কারণ পাঞ্জাব প্রশাসনের সকল দায়িত্বই তখন ইংরেজ রেসিডেন্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। দ্বিতীয় ইল-শিখ যুদ্ধের জন্য লর্ড ডালহৌসী শিখদের দায়ী করলেও জেমস মিল, কানিংহাম প্রমুখ ঐতিহাসিক এই যুদ্ধের জন্য কোম্পানীর আগ্রাসী নীতিকেই দায়ী করেছেন। ট্রটার (Trotter)-এর মতে পাঞ্জাব জয়ের ক্ষেত্রে ডালহৌসীর নীতি ছিল ‘নীতিবর্জিত ও অযৌক্তিক’। বেল (Bell)-এর মতে পাঞ্জাব দখল হল ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ (‘a violent breach of trust’)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, পাঞ্জাব জয়ের ফলে কোম্পানীর সাম্রাজ্যের সীমা আফগানিস্তানকে স্পর্শ করে এবং এর ফলে কোম্পানী আফগান সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাঞ্জাব দখল না করলে আফগানিস্তান নিয়ে ইংরেজদের এতটা বিব্রত হতে হত না।
শিখদের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা :
রণজিৎ সিংহ ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা শিখরাজ্যে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বৈরতান্ত্রিক হলেও রণজিৎ সিংহের শাসনব্যবস্থা ছিল প্রজাহিতৈষী স্বৈরতন্ত্র। শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাজা। তাঁর হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকলেও, তিনি কখনই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন না। মন্ত্রীমণ্ডলীর পরামর্শ অনুসারে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র রাজ্যকে তিনি চারটি প্রদেশ বা সুবা-য় ভাগ করেন। সেগুলি হল—লাহোর, কাশ্মীর, পেশোয়ার ও মুলতান। তাঁর রাজধানী ছিল। লাহোর। প্রদেশের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘নাজিম’। প্রদেশগুলি আবার জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলার শাসনভার ছিল শরদারের ওপর। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম-শিখ যোগ্যতাসম্পন্ন সকলেই। উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হতে পারত। কোন ধর্মীয় বা জাতিগত ভেদাভেদ নয়—যোগ্যতাই ছিল একমাত্র মাপকাঠি। তাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সুসংহত ছিল না। উৎপন্ন ফসলের ২/ বা ১/৩ অংশ তিনি রাজস্ব হিসেবে আদায় করতেন। এছাড়া, বণিকদের কাছ থেকে ‘শুদ্ধ’ আদায় করা হত। অ্যালার্ড, ভো প্রমুখ বিদেশী সেনানায়কদের সাহায্য নিয়ে তিনি এক শক্তিশালী সেনাদল গড়ে তোলেন। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
শিখ শক্তির পতনের কারণ :
শিখদের পতনের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। (১) শিখ শক্তির পতনের জন্য মহারাজা রণজিৎ সিংহের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। তিনি রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা ছিলেন এবং সব ক্ষমতাই তাঁর কুক্ষিগত ছিল। বলা হয়, তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর রাষ্ট্র (state in person)। তাঁর মৃত্যুর পর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে এক বিরাট শূন্যতা দেখা দেয় এবং এর ফলে পুরো শাসনযন্ত্র ভেঙে পড়ে। (২) রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেনাবাহিনী উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে এবং দরবারের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এর ফলাফল রাষ্ট্রের পক্ষে ভাল হয়নি। (৩) রণজিৎ সিংহের রাজ্যের আয় অপেক্ষা তাঁর সেনাবাহিনীর ব্যয় ছিল বেশি। এজন্য তিনি বেতনের পরিবর্তে সৈন্যদের জায়গীর দিতে শুরু করেন। আরগীর পেয়ে সেনাদল রাষ্ট্রের স্বার্থ উপেক্ষা করে জায়গীরের দিকেই বেশি নজর দিতে শুরু করে, যা রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকারক। (৪) যুদ্ধে শিখ সেনাপতিদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ও বিশ্বাসঘাতকতা শিখদের পতনের অন্যতম কারণ। প্রথম ই-শিখ যুদ্ধে লাল সিংহ ও তেজ সিংহ ইংরেজদের অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেন। (৫) এ সময় ভারতে শিখদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রবল পরাক্রান্ত ইংরেজরা।দুর্বল অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত শিখরা কখনই ইংরেজদের রণকৌশল, উন্নত মানের কামান এবং দক্ষ সেনাপতিদের সমকক্ষ ছিল না। তাই ইংরেজ শক্তির জয় ও শিখদের পতন এক রকম সুনিশ্চিত ছিল।
অন্যান্য রাজ্য জয় (Other Conquests) :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যুদ্ধের মাধ্যমে মারাঠা, মহীশূর, শিখ প্রভৃতি রাজ্যগুলি জয় করে। লর্ড ওয়েলেসলি বশ্যতামূলক চুক্তির দ্বারা নিজাম, অযোধ্যার নবাব, ভরতপুরের রাজা এবং বিভিন্ন রাজপুত রাজ্যের ওপর কোম্পানীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৪-১৬ খ্রিস্টাব্দের নেপাল যুদ্ধ ও সগৌলির সন্ধি (১৮১৬ খ্রিঃ) দ্বারা সিমলা, মুসৌরী, নৈনিতাল, আলমোড়া প্রভৃতি পার্বত্য অঞ্চল-সহ বর্তমান কুমায়ুন ও গাড়ওয়াল জেলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮২৪-২৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের ফলে ইয়ান্দাবুর সন্ধি দ্বারা আসাম, কাছাড়, মণিপুর, জয়ন্তিয়া, আরাকান ও তেনাসেরিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের দ্বারা সমগ্র দক্ষিণ ব্রহ্ম এবং ১৮৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের দ্বারা ব্রহ্মদেশের বাকি অংশ ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড এলেনবরা সিন্ধুদেশ জয় করেন।