এই অধ্যায়ে আমরা মাদ্রাজ ও উত্তরপ্রদেশের ভূমি বন্দোবস্ত [ Land Settlement in Madras and U. P. ] নিয়ে আলোচনা করব।
(ক) রায়তওয়ারী ব্যবস্থা :
ভারতের দক্ষিণ (মাম্রাজ প্রেসিডেন্সীর কিছু অঞ্চল বাদে) ও দক্ষিণ- পশ্চিম অঞ্চলে আলেকজান্ডার রীড ও স্যার টমাস মনরো-র উদ্যোগে রায়তওয়ারী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (১৮২০ খ্রিঃ)। এই ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কৃষকেরা সরাসরি সরকারকেই রাজস্ব দিত — কোন জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে নয়। জমি জরিপ করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় এবং উৎপাদনের ভিত্তিতে জমিকে ৯টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। এই ব্যবস্থায় জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব ছিল না—ছিল জমি ভোগ করার স্বত্ব। রাজস্বের হার ছিল খুব উঁচু এবং সাধারণত ত্রিশ বছর অন্তর রাজস্বের হার পরিবর্তন করা হত।
(১) জমিদারী প্রথার নানা কুফল লক্ষ্য করেই রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়, কিন্তু কালক্রমে কৃষকেরা জমিদারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথা সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক ড. তারা চাঁদ বলেন যে, এই ব্যবস্থায় প্রজারা বহু জমিদারের পরিবর্তে এক বিরাট জমিদার বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। (২) এই ব্যবস্থায় খাজনার হার ছিল খুব উঁচু, যা দেবার সামর্থ্য প্রজাদের ছিল না। উৎপন্ন ফসলের শতকরা ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত। (৩) এই ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো স্থায়িভাবে রাজস্ব ধার্য করা হয়নি। সরকার ইচ্ছা করলে কুড়ি বা ত্রিশ বছর অন্তর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারত। রায়ত বাড়তি খাজনা না দিলে তাকে জমি থেকে উৎখাত করা হত। (৪) বন্যা, অজন্মা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষকেরা রাজস্বের হাত থেকে রেহাই পেত না। এর ফলে সরকারি রাজস্ব মেটাতে তাদের মহাজনদের শরণাপন্ন হতে হত। রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, জমির অস্থায়ী বন্দোবস্তুই জনসাধারণের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ।
(খ) মহলওয়ারী ব্যবস্থা :
গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে। মহলওয়ারী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (১৮২২ খ্রিঃ)। এই প্রথা জমিদারী প্রথার অনুরূপ। এই প্রথা অনুসারে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ‘মহল’ বা ‘তালুক’ সৃষ্টি করা হত এবং কোন একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তিকে যৌথভাবে রাজস্ব দেবার শর্তে ওই মহলের ইজারা দেওয়া হত। এই ব্যবস্থায় কিছুদিন পর পর ভূমি রাজস্ব পুনর্নির্ধারণ করা হত। এতে জমিদারের প্রাপ্য ছিল রাজস্বের মাত্র ২০% এবং সরকার পেত ৮০%। পরে অবশ্য সরকারের প্রাপ্য অনেক হ্রাস করা হয়। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনে এলফিনস্টোনের অবদান উল্লেখযোগ্য।
এই ব্যবস্থাও ত্রুটিহীন ছিল না। এতে জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব স্বীকৃত হয়নি। এই ব্যবস্থায় জমিদার নয়—কৃষকেরা সরকারের অধীনে আসে। কৃষকের দেয় খাজনার পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে কৃষকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, এই ব্যবস্থায় ধন সঞ্চয় বা মানুষের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রের চাহিদার ওপরেও কোন সীমারেখা টানা হয়নি। অতিরিক্ত কঠোরতার ফলে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
ভারতীয় সমাজে ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার প্রভাব | Impact of the Land Revenue Settlements on Indian Society
কৃষক-ভাড়াটিয়া প্রজা :
ইংরেজ-সৃষ্ট নতুন ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থাদি ভারতীয় সমাজ ও জনজীবনে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনে। এর ফলে এদেশের চিরাচরিত ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এবং নতুন ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে। মোগল আমলে জমিদার ছিল রাজস্ব আদায়কারী মাত্র, কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার ভূস্বামী বা জমির মালিকে পরিণত হন। জমি হস্তান্তরযোগ্য ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং জমিদার জমি বিক্রয়, দান বা বন্ধক রাখার অধিকারী হন। অপরদিকে কৃষকরা ভাড়াটিয়া প্রজায় পরিণত হয়। জমিদার ইচ্ছা করলে যে-কোন সময় প্রজাকে জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য অত্যাচার করতেন। ‘রায়তওয়ারী’ ব্যবস্থায় কৃষককে জমির মালিক বলে ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবে জমির ওপর কৃষকের অধিকার ছিল খুবই সীমিত। এই ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল খুবই উঁচু, যা মেটাবার সামর্থ্য কৃষকদের প্রায়ই থাকত না। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারের পরিবর্তে সরকারি কর্মচারীরা কৃষকদের ওপর অত্যাচার করত।
ANCIENT AND MEDIVEL INDIA 2ND EDITION Paperback
Key Highlights:
Covers the complete UPSC and State service examinations syllabus.
Written in an easy-to-grasp and extremely lucid and eloquent manner.
Key points highlighted in boxes.
Updated questions, facts, pictures, flowcharts and new maps for better clarity.
A detachable chart for an easy and instant Pre-Examination revision.
Numerous Chapter-wise practice questions for both Prelims and Mains.
কৃষকের দুর্দশা :
জমিদার প্রজার কাছ থেকে ইচ্ছামতো রাজস্ব আদায় করতে পারতেন। রায়তওয়ারী ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল উৎপন্ন ফসলের ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ। শস্যহানি হলেও প্রজারা খাজনার হাত থেকে অব্যাহতি পেত না। রাজস্ব ছাড়াও তাদের কাছ থেকে জুলুম করে আরও নানা ধরনের অবৈধ কর আদায় করা হত, যা দেবার সামর্থ্য তাদের ছিল না। বেশি রাজস্বের লোভে অনেক সময় তাদের উৎখাত করে অন্য কৃষককে জমি দেওয়া হত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষক ছিল জমিদারের প্রজা, আর রায়তওয়ারী বন্দোবস্তে তারা ছিল সরকারের প্রজা। সব ব্যবস্থাতেই কৃষকের অবস্থা ছিল সমান।
মহাজন শ্রেণীর আবির্ভাব :
পূর্বে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব দেবার পদ্ধতি চালু ছিল। ইংরেজ সরকার এই রীতি বাতিল করে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের রীতি চালু করে। এর ফলে প্রজারা ফসল বিক্রি করে সরকারকে রাজস্ব মেটাত এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করত। দুর্ভিক্ষ, অজন্মা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল না হলেও সরকারের প্রাপ্য তাদের মেটাতেই হত। এই অবস্থায় তারা ঋণ গ্রহণে বাধ্য হত এবং তাদের ঋণ দেবার জন্য গ্রামাঞ্চলে নতুন ‘মহাজন’ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। তারা চড়া সুদে কৃষকদের ঋণ দিত। ঋণ শোধ করতে না পারলে ঋণগ্রস্ত কৃষকের জমি ও সম্পত্তি ক্রোক করা হত। এইভাবে ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকে পরিণত হয়। রনেশচন্দ্র দত্তের মতে, রায়তওয়ারী ব্যবস্থায় শোষণের তীব্রতা ছিল বেশি এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অপেক্ষা কৃষকের পক্ষে অধিকতর ক্ষতিকারক ছিল।
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় :
খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদাররা উপস্বত্বভোগীদের মধ্যে জমি ভাগ করে দেন। এর ফলে জমিদার ও প্রজার মধ্যে প্রায় পাঁচ-ছজন উপস্বত্বভোগী বা মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব হয়। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে জমি বা প্রজার কোন সম্পর্কই ছিল না। শোষণের মাধ্যমে এইসব গোষ্ঠী প্রভূত ধনশালী হয়ে শহরে বিলাস-ব্যসনে দিন কাটাতে থাকে। ইংরেজী শিক্ষাগ্রহণ করে তারা আধুনিক ভাবধারায় দীক্ষিত হয়। এইভাবে সমাজে এক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়—পরবর্তী ভারত ইতিহাসে এই সম্প্রদায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
বিষয় সংক্ষেপ :
ভারতের প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড কর্নওয়ালিস, লর্ড বেন্টিঙ্ক ও লর্ড ডালহৌসীর নাম অতি উল্লেখযোগ্য।
হেস্টিংস দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজের হাতে দেওয়ানী গ্রহণ করেন। রাজস্ব সংস্কারের ব্যাপারে তিনি প্রথমে পাঁচসালা ও পরে একসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। তিনি রাজস্ব বোর্ড ও আমিনী কমিশন গঠন করেন। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রেও তিনি বেশ কিছু সংস্কার প্রবর্তন করেন।
বিচারবিভাগীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কর্নওয়ালিসের সংস্কারগুলি উল্লেখযোগ্য। তিনি সিভিল সার্ভিস গঠন করেন। জেলাগুলি শাসনব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ‘কর্নওয়ালিস কোড’ তাঁর অন্যতম কীর্তি।
বেন্টিঙ্কের আমলে উচ্চ আদালতে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। তিনি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড সংকলন করেন।
ডালহৌসী ‘আধুনিক পাঞ্জাবের জনক’। রেলপথ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং ‘পাবলিক ওয়ার্কস্ ডিপার্টমেন্ট’ (P.W.D.) প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত।
কর্নওয়ালিসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন। এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী ছিল। এই সময় রায়তওয়ারী ও মহলওয়ারী ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়।