বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত |  Land Revenue System in Bengal-The Permanent Settlement

এই অধ্যায়ে আমরা বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত [ Land Revenue System in Bengal-The Permanent Settlement ] নিয়ে আলোচনা করব।

Land Revenue System in Bengal-The Permanent Settlement
বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত |  Land Revenue System in Bengal-The Permanent Settlement

হেস্টিংস-প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থার ত্রুটি :

 কোম্পানীর ভূমি রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘পাঁচসালা বন্দোবস্তু’ এবং পরে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে একসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। প্রতি বছর জমি নীলামে দেওয়ার ফলে জমি থেকে বাৎসরিক আয়ের কোন নিশ্চয়তা ছিল না। প্রতি বছর ইজারাদার বদল হওয়ায় তারা জমির উন্নতির দিকে নজর দিত না বরং যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদাররা প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালাত। অনেক সময় দরিদ্র প্রজা নির্যাতনের ভয়ে জমি। ছেড়ে পালাত। এইসব অসুবিধা দূর করে একটি সুষ্ঠু রাজস্ব-ব্যবস্থা প্রবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

শোর-গ্রান্ট বিতর্ক :

১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনে ভূমি-রাজস্ব বিষয়ে অনিশ্চয়তা দূর করে জমিদারদের সঙ্গে স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলা হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের পরিচালক সভাও কর্নওয়ালিসকে বাংলায় স্থায়িভাবে ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দিয়ে ভারতে পাঠান। ভারতে এসে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তৃত অনুসন্ধান ও আলোচনা চালান। জমির বন্দোবস্ত সম্পর্কে এ সময় দুটি পরস্পর-বিরোধী মতের উৎপত্তি হয়। রাজস্ব বিভাগের প্রধান স্যার জন শোর বলেন যে, মোগল আমলে জমিদারই ছিল জমির মালিক এবং তাদের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করা উচিত। তাঁর মতে জমি জরিপ না করে বা প্রকৃত রাজস্বের পরিমাণ স্থির না করে এক্ষুণি জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা ঠিক হবে না, কারণ তাতে কোম্পানীর ক্ষতির সম্ভাবনাই থাকবে।

দশসালা বন্দোবস্ত :

স্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে তিনি দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। অপরপক্ষে, কোম্পানীর দলিল বিভাগের প্রধান জেমস্ গ্রান্ট শোরের মতের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন যে, মোগল, আমলে জমির প্রকৃত মালিক ছিল সরকার জমিদার ছিলেন রাজস্ব-সংগ্রাহক মাত্র। ইংল্যান্ডের জমিদার পরিবারের সন্তান লর্ড কর্নওয়ালিস সেদেশের অনুকরণে ভারতেও জমিদারদের মালিকানা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। বহু আলোচনার পর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি তিনি জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘোষণা করেন। এই ব্যবস্থা ‘দশসালা বন্দোবস্তু’ নামে পরিচিত। এই সঙ্গে তিনি একথাও ঘোষণা করেন যে, পরিচালক সভার অনুমতি পাওয়া গেলে এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা হবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত :

পরিচালক সভার অনুমোদন পাওয়ার পর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মার্চ ‘দশসালা বন্দোবস্তু’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে বারাণসী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর কোন কোন স্থানে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থা অনুসারে স্থির হয় যে, (১) জমিদার-তালুকদাররা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের দেয় রাজস্ব সরকারকে প্রদান করে বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগ করতে পারবেন। (২) নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হলে সমগ্র জমিদারী বা তার অংশ বিক্রি করে রাজস্ব মেটাতে হবে। (৩) ভবিষ্যতে খরা, বন্যা, মহামারী বা অন্য কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্ব মকুব হবে না।

 চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পশ্চাতে কোম্পানীর বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য বা স্বার্থ ছিল। (১) কোম্পানী আশা করেছিল যে, এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে এবং এর ফলে তারা তাদের আয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবে। (২) এর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে রাজকীয় অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত সম্প্রদায় গড়ে উঠবে, যারা তাদের প্রধান সমর্থক হিসেবে কাজ করবে। (৩) কর্নওয়ালিস আশা করেন যে, জমিতে স্থায়িভাবে স্বত্ব পেলে জমিদাররা কৃষির উন্নতির জন্য জমিতে বিনিযোগ করবেন। এতে দেশ সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে এবং এর ফলে প্রকৃত লাভ হবে কোম্পানীরই।

Read More

প্রকৃত  উদ্ভাবক :

কর্নওয়ালিসের আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন হলেও, তিনি কিন্তু এর উদ্ভাবক ছিলেন না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার বহুপূর্বে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানীর কর্মচারী ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাও প্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলেন। এরপর হেনরী পারলো, ড্যারিস্, টমাস ন প্রমুখ কর্মচারী এই ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেখান। ওয়ারেন হেস্টিংসের পরিষদের অন্যতম সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে এক স্মারকলিপি য কোম্পানীর পরিচালক সভার কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে সুপারিশ করেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনেও এর পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কর্নওয়ালিস কখনই এই ব্যবস্থার উদ্ভাবক নন। ড. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেন যে, সীমিত অর্থে’ কর্নওয়ালিসকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক বলা যায় (“He may be regarded as the author of the permanent settlement in a limited sense.”)

ফলাফল :

এই ব্যবস্থার সুফল ও কুফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। মার্শম্যান-এর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটি বলিষ্ঠ, সাহসিকতাপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ (“It was a bold, brave and wise measure.”)। স্মিথ বলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে লর্ড কর্নওয়ালিস এক বিপ্লব ঘটান (Lord Cornwallis introduced his permanent settlement and effected a revolution.”) বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী নেতা রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, “১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ জাতি কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ ও সফল পদক্ষেপ” (“Lord Cornwallis Permanent Settlement of 1793 is the wisest and the most successful measure which the British nation has ever adopted in India)। (১) এই ব্যবস্থার ফলে জমিদারের অবস্থা উন্নততর হয় এবং সরকারের প্রাপ্য – রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। এর ফলে সরকারি বাজেটের অনেক সুবিধা হয়। (২) জমির ওপর জমিদারের স্বপ্ন সুনিশ্চিত হওয়ায় তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় কৃষির উন্নতিতে সচেষ্ট হন। (৩) সরকারের অনুগত একটি রাজভক্ত জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়, যার ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। (৪) খাজনা সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদের সুবিধা হয়। ইজারাদারদের শোষণ এবং ঘন ঘন জমি থেকে উচ্ছেদের আশঙ্খা থেকে তারা রক্ষা পায়।

এই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। হোমস্-এর মতে এই বন্দোবস্ত ছিল মারাত্মক ভুল (“The permanent settlement was a sad blunder”)। এডওয়ার্ড থর্নটন বলেন যে, চরম অজ্ঞতা থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃষ্টি হয়। ব্যাডেন পাওয়েল বলেন যে, কর্নওয়ালিস- প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেক প্রত্যাশাকে ধ্বংস করে এমন কিছু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল যা চিন্তার বাইরে ছিল। বস্তুত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফলই ছিল বেশি।

সরকারের ক্ষতি :

এই ব্যবস্থায় সরকারের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হলেও এর ফলে ভবিষ্যতে ভূমি-রাজস্ব থেকে সরকারের আমবৃদ্ধির সম্ভাবনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। জমিদার প্রজাদের ওপর বেশি রাজস্ব চাপিয়ে আয়বৃদ্ধি করলেও, সরকারের কিন্তু আয়বৃদ্ধির আর কোন সুযোগ রইল না। এছাড়া, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পতিত জমি পুনরুদ্ধার  প্রভৃতির ফলে জমিদারী আর বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও সরকারি আয় কিন্তু বৃদ্ধি পায়নি।

 জমিদারদের ওপর প্রভাব :

ব্যবস্থা জমিদারদের ওপর মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। (১) এই ব্যবস্থায় জমিদারের দেয় রাজস্বের হার ছিল খুব উঁচু। জমিদার তাঁর সংগৃহীত রাজস্বের দশ ভাগের নয়-ভাগ সরকারকে দিতে বাধ্য ছিলেন। ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুসারে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দিতে না পারার জন্য বহু প্রাচীন জমিদার জমিদারীচ্যুত হন। এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু প্রবর্তিত হওয়ার মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক প্রাচীন জমিদার উচ্ছেদ হয়ে যান। তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কতটা স্থায়ী ছিল (“How permanent was the Permanent Settlement ?”) তা নিয়ে অধ্যাপক জমিদারদের ওপর পি. জে. মার্শাল (P. J. Marshall) প্রশ্ন তুলেছেন। (২) ধনশালী বণিক ও ব্যবসায়ীদের অনেকে এই জমিদারীগুলি ক্রয় করেন। এইসব ভুঁইফোঁড় জমিদারদের সঙ্গে কৃষক বা জমির কোন সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা জমিদারীকে বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্র বলে মনে করতেন। প্রজাকল্যাণ নয়—প্রজা-শোষণের মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনই ছিল তাদের লক্ষ্য। (৩) এইসব নতুন জমিদার জমিদারীর দায়িত্ব নায়েব-গোমস্তাদের হাতে দিয়ে শহরে বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বাস করতেন। এঁরা ‘অনুপস্থিত জমিদার’ নামে পরিচিত ছিলেন। গ্রামীণ সম্পদ শহরে ব্যয় হওয়ায় গ্রামগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ‘অনুপস্থিত জমিদারদের কর্মচারীরা মুনাফার লোভে প্রজাদের ওপর অধিক করের বোঝা চাপিয়ে জুলুম চালাতে থাকে। এর ফলে তাদের দুর্দশা সীমা ছাড়িয়ে যায়। (৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শিল্প ও বাণিজ্যে অর্থ বিনিয়োগের হার প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পায়। শিল্পপতি ও বণিকরা অনিশ্চিত শিল্প-বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ করা অপেক্ষা স্থায়ী মালিকানাধীন জমিতে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকে। এর ফলে যেমন বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি নতুন জমিদার শ্রেণীর আবির্ভাবে প্রজার সর্বনাশ হয়। (৫) সরকার আশা করেছিল যে, স্থায়িভাবে মালিকানা পেলে জমিদাররা জমির উন্নতি বিধান, কৃষির বিস্তার, সেচের প্রসার, পতিত জমি পুনরুদ্ধার, দুর্ভিক্ষ নিবারণ, শিক্ষা বিস্তার প্রভৃতি কাজে সচেষ্ট হবেন। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। (৬) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আর একটি কূফল হল ‘পত্তনি প্রথা’-র উদ্ভব। কোন কোন জমিদার দ্রুত খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে তাঁর জমিদারীকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের শর্তে অন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের তা ‘পত্তনি’ দেন। এই পত্তনিদারদের বলা হত ‘সদর পত্তনিদার’। এরা আবার অনুরূপভাবে অন্যদের জমি পত্তনি দিত। তাদের বলা হত ‘দর পত্তনিদার’। এর পরের স্তরে ছিল ‘দর-দর পত্তনিদার’। এইভাবে মূল জমিদার ও রায়তের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছ’টি স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের আবির্ভাব হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল যতটা বেশি পরিমাণে সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। এর ফলে প্রজাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

কৃষকদের ওপর প্রভাব :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রায়ত বা কৃষক সম্প্রদায়। জমির ওপর জমিদারের মালিকানা স্বীকৃত হলেও, জমির ওপর কৃষকের কোন মালিকানা স্বত্ব ছিল না। জমিদার প্রজাকে ইচ্ছামতো জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন (“The peasant became in effect, a tenant at will of the Zaminder Spear)। এই ব্যবস্থায় জমিদারদের ওপর খুব উঁচু হারে খাজনা ধার্য করা হয়। জমিদাররা এই খাজনা কৃষকদের ওপর চালান করে দেন। ড. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের খালি চেকে সই করে দেওয়া হয়। তাঁরা তাতে ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক বসাতে পারতেন (“It gave a blank cheque to the Zaminders.”)। তাঁরা নানা রকম জুলুম করে প্রজাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো বেশি খাজনা আদায় করতেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদাররা সরকারকে ৩৫ লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব দিতে স্বীকৃত হয় এবং নিজেরা রায়তদের কাছ থেকে আদায় করে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ পাউন্ড। এই বাড়তি অর্থের সামান্য অংশও কিন্তু তারা সরকারকে দেয়নি। জমিদারদের অত্যাচারে প্রজাদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে। তাই প্রজাস্বার্থ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার ১৮৫৯ ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে। উনিশ শতকের সূচনা থেকে রামমোহন রায়, লালবিহারী দে, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত সকলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তদের দুর্দশার কথা বলেছেন। রমেশচন্দ্র দত্ত ‘বাংলার কৃষক’ গ্রন্থে কৃষকদের দুরবস্থার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে দায়ী করেছেন।

সামাজিক তাৎপর্য :

ড. তারা  চাঁদ (Dr. Tara Chand) বলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতের সামাজিক সংগঠন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। চিরাচরিত গ্রামীণ সংগঠন ধ্বংস হয়, সম্পত্তি-সংক্রান্ত সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে, নতুন সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিপ্লব ঘটে (“The settlement destroyed the old village community, changed the property relations, created new social classes and caused a social revolution in the Indian countryside.”-History of Freedom Movement in India, Vol. I, Tara Chand, P. 252 )। জমিদার, পত্তনিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী প্রভৃতির আবির্ভাব সমাজে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সূচনা করে। অপরদিকে, গ্রামীণ কৃষক ও কারিগরেরা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হয়। এইভাবে গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ঐতিহ্যগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে যায়। কার্ল মার্কস-এর মতে সম্পর্কের এই পরিবর্তনই সামাজিক বিপ্লব ঘটায় ।

Leave a Comment