আজ, নিম্নলিখিত নিবন্ধে আমরা ভারত ইতিহাসের গতিধারা (১৭০৭-৬৫ খ্রিঃ) (Major Developments of Indian History) ও মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমিক পতন (Gradual Break up of the Mughal Empire) সম্পর্কে আলোচনা করব।
সাম্রাজ্যের বিশালতা, জনসংখ্যা, আর্থিক সম্পদ ও সামরিক বলের দিক থেকে সমগ্র বিশ্বেরমধ্যযুগের ইতিহাসে মোগল সাম্রাজ্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই সাম্রাজ্য কাবুল থেকে গৌহাটি এবং কাশ্মীর থেকে ‘সুদূর দক্ষিণ’ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইতিপূর্বে ভারত ইতিহাসে এত বৃহৎ সাম্রাজ্য আর কখনও স্থাপিত হয়নি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে মোগল সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয় এবং এরপর মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই তা একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঐতিহাসিক স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে, “মোগল সাম্রাজ্যের পতন এমন আকস্মিকভাবে হয়েছিল যে, আপাতদৃষ্টিতে, তা বিস্ময়কর বলে মনে হয়। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র আশ্চর্য হয়ে ভাববে যে, ঐ সাম্রাজ্য অনেক আগে ভেঙে না পড়ে এতদিন টিকল কি করে।”
(১) মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমিক পতন (Gradual Break up of the Mughal Empire) :
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর বহু পূর্বে তাঁর জীবদ্দশাতেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয় এবং এর জন্য দায়ী ছিল তাঁর অনুসৃত ভ্রান্ত ও অবাস্তব নীতি। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র পতনের সূচনা ঔরঙ্গজেবের আমলে “হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি আকবর-অনুসৃত উদারতার স্থলে সংকীর্ণতা, পরধর্মসহিষ্ণুতার পরিবর্তে পরধর্ম-বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতা এবং প্রজাবর্গের প্রতি সম-ব্যবহারের পরিবর্তে অ-মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন ও বঞ্চনার নীতি গ্রহণ করে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কে মোগল সাম্রাজ্যের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত করেন। তাঁর অনুদার নীতির কলে রাজপুত, শিখ, সৎনামী, জাঠ, বুন্দেলা, মারাঠা এবং ছোট-বড় বহু হিন্দু জমিদার ও কৃষক বিদ্রোহে সামিল হয়। মারাঠা ও বিজাপুর-গোলকুণ্ডা রাজ্যের বিরুদ্ধে এক নিষ্ফল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তিনি তাঁর রাজত্বকালের শেষ পঁচিশ বছর রাজধানী থেকে বহু দূরে দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেন। এর ফলে সম্রাটের অনুপস্থিতির জন্য উত্তর ভারতে তীর শাসন-সংকট, অরাজকতা, বিদ্রোহ ও নানা ক্ষয়-ক্ষতি দেখা দেয়।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রিঃ) পর তাঁর যে-সব উত্তরাধিকারী সিংহাসনে বসেন তারা সকলেই ছিলেন অপদার্থ, দুর্বলচিত্ত ও বিলাসপ্রিয়। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে তাঁর তিন পুত্রের দুর্বল উত্তরাধিকারী মধ্যে ভ্রাতৃযুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইকে হত্যা করে জ্যেষ্ঠপুত্র মুয়াজ্জম ‘বাহাদুর শাহ’ (১৭০৭-১২ খ্রিঃ) নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। সম্রাটসুলভ কোন গুণই তাঁর চরিত্রে ছিল না। বৃদ্ধ, দুর্বল, অলস ও অপদার্থ এই সম্রাটের আমলে রাজপুত, মারাঠা ও শিখরা বিদ্রোহ করে। তাঁর আমলে ইরানী গোষ্ঠীর নেতা জুলফিকার খাঁ সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর চার পুত্রের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বিজয়ী জাহান্দার শাহ (১৭১২-১৩ খ্রিঃ) অপর তিন ভ্রাতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। একান্ন বছর বয়সে সিংহাসনে বসে তিনি আমোদ-প্রমোদে গা ঢেলে দেন এবং এর ফলে শাসনকার্যে চরম অব্যবস্থা দেখা দেয়। উত্তরাধিকার যুদ্ধে তাঁর অন্যতম সাহায্যকারী জুলফিকার খাঁ-কে তিনি প্রধান উজির নিযুক্ত করেন এবং তিনি অচিরেই সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। জাহান্দার শাহের পক্ষে এক বছরও সিংহাসনে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। মৃত ভ্রাতা আজিম-উস-শানের দ্বিতীয় পুত্র: ফারুখশিয়ার (১৭১৬-১৯ খ্রিঃ) তাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজত্বকালে সৈয়দ প্র নামে পরিচিত দুই ভাই–সৈয়দ হোসেন আলি খাঁ ও সৈয়দ আবদুল্লা । সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা ফারুখশিয়রকে হত্যা করেন এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে বাহাদুর শাহের তিন পৌত্রকে পর পর সিংহাসনে বসান। প্রথম দু’জনকে হত্যার পর রওশন আখতারকে সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি ইতিহাসে মহম্মদ শাহ (১৭১৯-৪৬ খ্রিঃ) নামে পরিচিত। বিলাসের পদ্মকুণ্ডে নিমজ্জিত মহম্মদ শাহের অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে হায়দ্রাবাদ, অযোধ্যা ও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়, মারাঠারা রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করতে থাকে এবং আগ্রার নিকটস্থ জাঠ, পাঞ্জাবের শিখ ও রোহিলখণ্ডের আফগানরা সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হুয়ে পড়ে। এই চরম বিপত্তির মধ্যে পারস্যের অধিপতি নাদির শাহ-র ভারত আক্রমণ (১৭৩৯ খ্রিঃ) মোগল সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ১৭৪৮ থেকে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আফগান সম্রাট আহম্মদ শাহ আবদালীর বারংবার ভারত আক্রমণে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সমাধি রচিত হয়। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭-৫৭ খ্রিঃ) ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহে যোগদানের অপরাধে ইংরেজরা তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে এবং রেঙ্গুনে তাঁর মৃত্যু হয়। এইভাবে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
(২) মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ (Causes of the Downfall of the Mughal Empire) :
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে উইলিয়ম আরভিন, স্মিথ, স্যার যদুনাথ, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ প্রাচীন ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের বিশালতা, ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতি, দাক্ষিণাত্য নীতি, পরবর্তী মোগল সম্রাটদের দুর্বলতা ও প্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, অভিজ্ঞার্জনের নৈতিক অধঃপতন, সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রভৃতির কথা বলেন। আধুনিক ঐতিহাসিকরা উপরিউক্ত কারণগুলিকে গুরুত্ব দিলেও, তারা নতুন কিছু কারণের উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, এ সময় মোগল সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক- এমন কতকগুলি সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিল, যা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। ড. সতীশ চন্দ্র, আতাহার আলি, ইরফান হাবিব, মুজাফ্ফর আলম, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিক মোগল দরবারে দলাদলি, জায়গীরদারী সমস্যা, কৃষিসঙ্কট ও কৃষক বিদ্রোহ প্রভৃতি কারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
(১) বিশালতা : মোগল সাম্রাজ্যের বিশালতা তার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আকবরের আমলে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির সূচনা হয়, ঔরঙ্গজেবের আমলে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ঐ দিনে দিল্লী থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সত্যই খুব দুরূহ ছিল। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রায়ই শিল্পীর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করত। দূরবর্তী প্রদেশগুলির এইসব বিদ্রোহ দমন সত্যই খুব কষ্টসাধ্য ছিল।
(২) উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব : মোগলদের কোন সুস্পষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। এই কারণে কোন সম্রাটের মৃত্যু হলে তাঁর সব পুত্রই সিংহাসনের দাবিদার হতেন এবং সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব শুরু হত। শাহজাহানের জীবদ্দশাতেই তাঁর পুত্ররা এ ধরনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব তাঁর সকল ভ্রাতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে এবং ১৭০৭ থেকে ১৭১১ খ্রিস্টাব্দ মাত্র তের বছরের মধ্যে ছয় জন সম্রাট সিংহাসনে বসেন। এঁদের মধ্যে কেবল বাহাদুর শাহ ও মহম্মদ শাহ ব্যতীত সকলেই নিহত হন। বিভিন্ন আমীর-ওমরাহ ও রাজকর্মচারীরা এইসব দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ করলে অবস্থা জটিলতর হয়ে ওঠে (“The prolonged anarchy involved in the repeated wars of succession was a potent influence in bringing about the ruin of the imperial fabric. V. A. Smith, Oxford History of India, 1928, P. 466 )
(৩) দুর্বল উত্তরাধিকার : মোগল সাম্রাজ্য স্বৈরাচারী ও সামরিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সাফল্য বহুলাংশে সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও যোগাতার ওপর নির্ভরশীল। ঔরঙ্গজেবের উত্তধাধিকারীদের অধিকাংশই ছিলেন অযোগ্য, অপদার্থ ও বিলাসপ্রিয়। ৬৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে বৃদ্ধ ও বিলাসপ্রিয় বাহাদুর শাহের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সম্রাট জাহান্দার শাহ সুরা ও নর্তকীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। সম্রাট ফারুখশিয়র অতিমাত্রায় প্রমোদাসক্ত ছিলেন। মহম্মদ শাহ ছিলেন ‘সর্বপ্রকার বিলাসের প্রতি অনুরক্ত’। এই সব অলস, অকর্মণ্য ও ব্যাভিচারী সম্রাটদের হাতে পড়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। নাদির শাহের আক্রমণের পর মোগল সাম্রাজ্য বস্তুত ‘বহুমূল্য পরিচ্ছদে ভূষিত একটি মৃতদেহ’ (‘a gorgeously dressed corpse’) ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।
(৪) অভিজাত শ্রেণীর অবক্ষয় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব : মোগল যুগের সূচনা পর্বে অভিজাত সম্প্রদায় ছিলেন সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। তাঁরা ছিলেন সদা সচেতন, দক্ষ ও অনুগত এবং বহুক্ষেত্রে তাঁরা দুর্বল মোগল সম্রাটদের পরিপূরক হয়ে কাজ করতেন। এই সব অভিজাতদের মধ্যে বৈরাম খাঁ, আবদুর রহিম, মহাবৎ খাঁ, মীর জুমলা, মানসিংহ প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজপরিবারের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে মোগল অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেও চরম অবক্ষয় দেখা দেয়। সাম্রাজ্যের মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে তাঁরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য দলাদলি। ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করেন। ঔরঙ্গজেবের জীবদ্দশায় দরবারে ইরানী, তুরানী ও হিন্দুস্থানী নামে তিনটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু হলে তিন গোষ্ঠীর মধ্যে তৎপরতা শুরু হয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থনে এগিয়ে আসে। সম্রাট বাহাদুর শাহ ও জাহান্দার শাহের আমলে ইরানী গোষ্ঠীর নেতা জুলফিকার খাঁ ও আসাদ, খাঁ সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং তাঁরাই সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফারুখশিয়র দিল্লীর সিংহাসনে বসলে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁ ও সৈয়দ হুসেন আলির নেতৃত্বে হিন্দুস্থানী গোষ্ঠী সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তুরানী গোষ্ঠীর নেতা আমিন খাঁ ও চিন্কিলিচ খাঁ তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করেন। ড. সতীশ চন্দ্র বলেন যে, এধরনের দলাদলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের পক্ষে শুভ হয়নি। এর ফলে জাতীয় জীবন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অক্ষম হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এবং রাষ্ট্র দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয়। ডঃ কালীকিঙ্কর দত্ত ও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেন (“The deterioration in the character of the nobility during the eighteenth century had a large share in hastening the decline of the Mughal Empire.”-K. K. Datta, vide An Advanced History of India, P. 530 ) ।
(৫) অর্থনৈতিক বিপর্যয় : অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সম্রাট আকবর মোগল সাম্রাজ্যের একটি সুদৃঢ় আর্থিক কাঠামো গঠন করলেও তাঁর উত্তরাধিকারীদের হাতে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দরবারের বিশাল জাঁকজমক, রাজ পরিবারের বিলাসিতা, সম্রাটদের স্থাপত্যানুরাগ, অভিজাতবর্গের উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং সেনাদলের বিশাল ব্যয়ভার সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। শাহজাহানের জাঁকজমক ও আড়ম্বরপ্রিয়তার ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেবের সীমাহীন যুদ্ধ মোগল অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। কৃষিকার্য, শিল্প ও বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড (Moreland) বলেন যে, “ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেশ যে দেউলিয়া তা স্পষ্ট হয়ে উঠল।” ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার -এর রচনা থেকে জানা যায় যে, ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে একদা পর পর তিনদিন রাজকীয় রন্ধনশালায় জ্বালানো সম্ভব হয়নি এবং ক্ষুধার জ্বালায় রাজকন্যারা পর্দা উপেক্ষা করে হারেম থেকে বেরিয়ে আসেন। বলা বাহুলা, এ ধরনের দেউলিয়া সরকারের পক্ষে কখনই টিকে থাকা সম্ভব নয়।
(৬) জায়গীরদারী সঙ্কট : ড. সতীশ চন্দ্র-র মতে, সাম্রাজ্যের পতনে জায়গীরদারী সঙ্কটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোগল যুগে বহু মনসবদারকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেওয়া হত এবং এই জায়গীরদারী ব্যবস্থাই বহুলাংশে মোগল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে জায়গীরদারী ব্যবস্থা প্রবল সঙ্কটের সম্মুখীন হয়, যদিও এই সঙ্কটের সূত্রপাত হয়েছিল। জাহাঙ্গীরের আমলেই। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মনসূরদারের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়, কিন্তু বণ্টনযোগ্য জমির পরিমাণ সে তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়া, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অশান্ত দাক্ষিণাত্য থেকে জায়গীরদাররা কখনই পুরোপুরি রাজস্ব আদায় করতে পারত না। এ কারণে সকলেই উত্তর ভারতে উর্বর জায়গীর পেতে চাইত। বলা বাহুল্য, এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল না। জায়গীর-প্রার্থী মনসবদারকে জায়গীরের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত এবং জায়গীর পেলেও সর্বদা ‘জমা’ (কাগজে-কলমে দেখানো রাজস্ব) ও ‘হাসিলের’ (প্রকৃত আদায়ীকৃত রাজস্ব) মধ্যে সামঞ্জস্য হত না। এমতাবস্থায় জায়গীর পাওয়ার জন্য মনসবদারদের মধ্যে দলাদলি চরমে ওঠে, জাতি ও ধর্মের সুপ্ত মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয় এবং অভিজাত সম্প্রদায় থেকে হিন্দুদের বিতাড়নের জিগির তোলা হয়। জায়গীর না পাওয়ায় বা নিম্নমানের জায়গীর পেয়ে ‘জমা’ ও ‘হাসিলের’ মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাম্রাজ্যে নানা দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয় এবং এর ফলে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
(৭) কৃষক বিদ্রোহ : ড. ইরফান হাবিব মনে করেন যে, মোগল যুগে জমিদার ও কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনই হল মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। এসময় জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছিল, কিন্তু জায়গীরদারদের আয় বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়া, জায়গীরের ওপর জায়গীরদারের অধিকার স্থায়ী ছিল না—কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে অন্যত্র বদলী করা হত। এ কারণে সব জায়গীরদারই চাইত যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করতে। এর ফলে অনেকেই যুদ্ধ অপেক্ষা রাজস্ব আদায়েই বেশি মনোযোগী ছিল। এতে দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচার ও শোষণের মাত্রাই বৃদ্ধি পেত এবং তারা কৃষিকার্য পরিত্যাগ করে পলায়ন করত। অনেক সময় অত্যাচারিত জমিদার ও কৃষকরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। মোগল যুগের শেষ পর্ব হল জাঠ, শিখ, সৎনামী—এই সব কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। এই সব বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের সংহতির মূলে প্রবল আঘাত হানে।
(৮) শিল্প-বাণিজ্যের বিনাশ : মোগল যুগে কৃষির অবনতি ঘটলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প পথ ছিল শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি। এদিকে মোগল বাদশাহের বিশেষ নজর ছিল না। রাজপুরুষরা বণিক ও কারিগরদের ওপর নানা ধরনের জুলুম চালাতেন। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির ফলে শিল্প-বাণিজ্যে মন্দা ভাব দেখা দেয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, শিল্পে উন্নততর আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে অনাগ্রহ এবং বহির্বাণিজ্য ও নৌ-বাণিজ্যের প্রতি উপেক্ষা ভারতীয় শিল্প- বাণিজাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। সম্রাট ফারুখশিয়র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে কিনা ওকে বাণিজ্যের অধিকার দান করলে রাজকোষে অর্থের টান পড়ে এবং নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব হয়, যা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করে।
(৯) সামরিক দুর্বলতা : ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম আরভিন (William Irvine) বলেন যে, সামরিক দক্ষতার অভাব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একমাত্র কারণ যদি না-ও হয়, তবে অন্তত প্রধান কারণ। এর সঙ্গে তুলনা করলে অন্যান্য ত্রুটি বা দুর্বলতার কোন গুরুত্বই নেই (“Military inefficiency was the principal, if not the sole cause of the Mughal Empire’s final collapse. All other defects and weaknesses were as nothing in comparison with this. মোগলদের সামরিক সংগঠন ছিল খুবই ত্রুটিপূর্ণ। (১) তুর্কী, আফগান, রাজপুত এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত মোগল বাহিনী কখনই ‘জাতীয় বাহিনী’ হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে কোন সংহতি গড়ে ওঠেনি এবং তাদের রণকৌশলও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। (২) যুদ্ধকালে সেনা সরবরাহের জন্য মোগলরা মনসবদারদের ওপর নির্ভর করত। তাই সেনাদের আনুগত্য থাকত নিজ নিজ প্রভু মনসবদারদের প্রতি সম্রাট বা রাষ্ট্রের প্রতি নয়। (৩) নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা রাখার শর্তে মনসবদারদের জায়গীর দেওয়া হত। অর্থাভাবে বহুক্ষেত্রে তারা কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা রাখত না এবং যে-সব সেনা রাখত তাদের যোগ্যতাও প্রশ্নাতীত ছিল না। (৪) মোগল সেনাবাহিনীর গতি ছিল অতি শ্লথ। হাট-বাজার, হারেম, নর্তকী, বিলাসের সব উপকরণ নিয়ে মোগল সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলত। সেনাবাহিনীতে অসামরিক লোকজনের সংখ্যাধিক্য থাকায় তা একটি বিশৃঙ্খল জনসমষ্টিতে পরিণত হয়, যার পক্ষে কোনভাবেই দ্রুতগতিসম্পন্ন মারাঠাদের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। (৫) শিবির জীবনের বিলাসিতায় সেনানায়কদের চরিত্রবল ও সংগ্রামী মনোভাব বিনষ্ট হয় এবং তাঁরা ‘মসলিনের ঘাঘরা পরিহিত পাণ্ডুর পুরুষ’-এ (‘pale persons in muslin petticoats’) পরিণত হন। তাদের পক্ষে আর সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। (৬) মোগলদের যুদ্ধাস্ত্র, কামান ও রণকৌশল—সবই ছিল পুরানো ধাঁচের ও নিম্নমানের। (৭) ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন যে, মধ্য এশিয়ার স্থলভাগ থেকে আগত মোগলরা নৌশক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। এর ফলে তাদের পক্ষে ইংরেজ ও অন্যান্য ইওরোপীয় শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি।
(১০) জাতীয়তাবোধের অভাব : ড. বিপান চন্দ্র বলেন যে, জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেমের অভাব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ (“An important socio- political cause of the downfall of the Mughal Empire was the absence of the spirit of political nationalism among the people. “Modern India, Bipan Chandra, P. 13)। সে যুগে দেশবাসীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠলেও, কোন প্রকার রাজনৈতিক সংহতি গড়ে ওঠেনি। মানুষের আনুগত্য ছিল ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মের প্রতি দেশের প্রতি নয়। তাই দেশের বিপদে কেউ দেশরক্ষায় অবতীর্ণ হয়নি।
(১১) ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব : মোগল সাম্রাজ্যের পতনে ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতির গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ইস্লামিক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হন এবং রাজপুত, জাঠ, বুন্দেলা, সংনামী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি রাজপুতদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন। ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে তাঁকে তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশ বছর দাক্ষিণাত্যে এক অন্তহীন ও নিষ্ফলা যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকতে হয়। তিনি মারাঠাদের দমনে ব্যর্থ হন এবং রাজধানীতে তাঁর অনুপস্থিতির কারণে সমগ্র উত্তর ভারতে এক চরমতম রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়, যার ফলে সাম্রাজ্য দুর্বলতর হয়ে পড়ে।
(১২) বৈদেশিক আক্রমণ : জাতীয় জীবনের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নাদির শাহ (১৭৩১ খ্রিঃ) এবং আহম্মদ শাহ আবদালী-র আক্রমণ (১৭৪৮-৬৮ খ্রিঃ) মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের ওপর চরম আঘাত হানে। মোগলদের পক্ষে আর ফিরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।